প্রচণ্ড গরমের কারনে এসির ব্যাবহার বাড়ছে । সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে এসি দূর্ঘটনা। গত পাঁচ বছরে প্রায় চারশো অধিক মানুষ এয়ার কন্ডিশনার (এসি) বিস্ফোরণে আহত হয়েছে । তাদের মধ্যে প্রায় ৭০ থেকে ৭৫ জন মারা গেছে। আমরা নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার একটি মসজিদে এয়ার কন্ডিশনার থেকে ভয়াবহতম বিস্ফোরণ প্রত্যক্ষ করেছি যেখানে একই সাথে ৩৪ জন মারা গিয়েছিল ।

আমাদের দেশে এসির রক্ষণাবেক্ষণে খুব অবহেলা করা হয়। কিন্তু মনে রাখা দরকার, এই যন্ত্রটি কিন্তু বাসার অন্যসব যন্ত্রের মতো নয়। এসির জন্য রক্ষণাবেক্ষণ খুবই জরুরি। প্রতিমাসে ফিল্টার পরিষ্কার করা ।  বছরে  অন্তত একবার Master Clean করা এবং সম্পূর্ন সিস্টেম সঠিক ভাবে কাজ করছে কিনা তা  প্রফেশনালদের দ্বারা চেক করা উচিত। বিশেষ করে শীতের সময় দীর্ঘ কয়েকমাস বন্ধ থাকার পর  এসি চালু করার আগে অবশ্যই Clean এবং চেক করে নেয়া উচিত।

এসি বিস্ফোরণের কারণ: 

রুমের আকার অনুপাতে এসি ব্যবহার করা উচিত। কিন্তু তা না করলে এসি দীর্ঘ সময় চলার কারনে এসি মাত্রাতিরিক্ত গরম হয়ে যায়। নিম্নমানের এসি হলে তো আর কোন কথাই নেই । এগুলোর ভেতরের যন্ত্রপাতি দুর্বল হওয়ার ফলে সেখানে কারিগরি ক্রুটি দেখা যায়, যা অনেক সময় আগুনের সূত্রপাত করতে পারে।

এসি দুর্ঘটনার আরেকটি বড় কারণ রক্ষণাবেক্ষণের অভাব। ফলে কারিগরি ক্রুটির কারণে এসিতে আগুন ধরে যেতে পারে বা এসির গ্যাসে আগুন লেগে সেটি ঘরে ছড়িয়ে পড়তে পারে।”

  • অনেক পুরনো বা নিম্নমানের এসি ব্যবহার ।
  • এসির পাওয়ার কেব্‌ল সঠিক স্পেক–এর ব্যবহার না করলে।
  • এসির ভেতরে বা বাহিরের বৈদ্যুতিক সংযোগ নড়বড়ে থাকা, যা শর্টসার্কিটের তৈরি করতে পারে ।
  • সঠিক রেটিংয়ের সার্কিট ব্রেকার ব্যবহার না করলে।
  • ইলেকট্রিক হাই ভোল্টেজের কারণে এসির ওপর অতিরিক্ত প্রেসার তৈরি হয়ে ।
  • রুমের আকার অনুযায়ী  এসি ব্যবহার না করা ।
  • এসির কনডেনসারে ময়লা জমলে কম্প্রেসারে হাই টেম্পারেচার বা হাই প্রেশার তৈরি হয়ে।
  • কম্প্রেসরের ভেতরে ময়লা আটকে জ্যাম তৈরি হওয়া ।
  • এসির ভেতরের পাইপে কোথাও জং বা ময়লা কারনে ব্লকেজ হয়ে এসির ভেতরে হাই প্রেশার তৈরি হয়ে কম্প্রেসার ব্লাস্ট হতে পারে ।
  • এসির পাইপ থেকে গ্যাস লিক হয়ে গ্যাস এসির ভেতরে বা রুমে  জমে থাকা ।
  • দীর্ঘক্ষণ একটানা এসি চালানো, যার কারনে এসির প্রেশার বেড়ে গিয়ে  সেটিকে গরম করে তোলে ।
  • অনেকদিন এসির সার্ভিসিং না করানো ।

ভালো আর্থিং ব্যবস্থা না থাকলে বজ্রপাত বা বৃষ্টির সময়ে এসি চালানো কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণ, কারণ  এটিও এসির দুর্ঘটনা ঘটাতে পারে।

 

বর্তমানে এসিতে যে ধরনের গ্যাস ব্যবহার করা হচ্ছে, সেই গ্যাসে সহজে আগুন ধরে । ফলে কোন কারণে সেটি লিক হয়ে জমে থাকলে, সেখানে বৈদ্যুতিক কারণে আগুনের স্ফুলিঙ্গ তৈরি করতে পারে বা ম্যাচের কাঠি জ্বালালে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটতে পারে।

প্রতিযোগিতা মূলক বাজারের কারণে অনেকে চীন থেকে অত্যন্ত কম মূল্যে নিম্নমানের দিয়ে তৈরি এসি এনে বাংলাদেশের বাজারে বিক্রি করছে। এমনকি অনেকে এসব এসির গায়ে নামী ব্রান্ডের স্টিকার লাগিয়ে বিক্রি করছে। এই ধরনের এসির গুণগত মান খারাপ হওয়ার কারনে সহজেই দুর্ঘটনার কবলে পড়তে পারে ।

 

 

এসি কেনার আগে বিশেষ সতর্ক থাকতে হবে, যাতে নকল কিনে ঠকতে না হয়। এজন্য ব্র্যান্ডগুলোর নিজস্ব শোরুম থেকে কেনাই ভালো ।

 

 

 

 

যেভাবে দুর্ঘটনা এড়ানো যেতে পারে:

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসি সঠিক ইন্সটলেশেন ও রক্ষণাবেক্ষণ অত্যন্ত জরুরি, যা বাংলাদেশে ততটা গুরুত্ব দেয়া হয় না।অন্য যেকোনো বৈদ্যুতিক যন্ত্রের মতো এসিরও বিশেষ যত্ন নেয়ার দরকার আছে। তাহলে একদিকে যন্ত্রটি যেমন ভালো থাকবে, তেমনি দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব হবে।

  • পেশাদারদের মাধ্যমে নিয়মিত সার্ভিসিং করানো
  • বৈদ্যুতিক সংযোগ, সকেট, সহ এসি  নিয়মিতভাবে পরীক্ষা করা।
  • সঠিক স্পেকে এবং ভালো মানের পাওয়ার কেব্‌ল ব্যবহার করা।
  • সঠিক রেটিংয়ের সার্কিট ব্রেকার ব্যবহার করা।
  • নির্ভরযোগ্য ব্র্যান্ডের এসি কেনা
  • রুমের আকার অনুযায়ী সঠিক মাত্রার এসি নির্ধারণ
  • মাঝে মাঝে বিরতি দিয়ে এসি ব্যাবহার করা ।
  • হাই ভোল্টেজ এড়াতে বাড়িতে সার্কিট ব্রেকার ব্যবহার করা।
  • বৃষ্টি ও বজ্রপাতের সময় এসি বন্ধ রাখতে পারলে ভাল ।
একটানা আট ঘণ্টার বেশি এসি ব্যবহার করা উচিত নয়। এছাড়া আউটডোর ইউনিট ছায়াযুক্ত স্থানে  বসাতে হবে, যেন সূর্যের তাপ কিছুটা কম থাকে এবং পর্যাপ্ত বাতাস চলাচল করতে পারে।

 

 

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) তড়িৎ ও ইলেক্ট্রনিক কৌশল বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ইয়াসির আরাফাত এসি বিস্ফোরন সম্পর্কে বলেন ।

 

 

বাসায় এসি ইনস্টল করার সময় উপযুক্ত সাইজের ক্যাবল (তার) ব্যবহার করা প্রয়োজন । একজন বৈদ্যুতিক বিশেষজ্ঞ হিসেবে আমি বলতে চাই, বাসায় সাধারণত এক টন, দেড় টন, দুই বা আড়াই টনের এসি ব্যবহার করা হয়। প্রথম দুটির ক্ষেত্রে আমরা যেন অবশ্যই ৪ মিলিমিটারের (যেটাকে ফোর আরএম বলে) ক্যাবল ব্যবহার করি। এর চেয়ে সরু মানের তার যেন আমরা ব্যবহার না করি। এরচেয়ে আরেকটু বড় সাইজের এসি হলে ৬ আরএম-এর ক্যাবল যেন ব্যবহার করি।

 

 

’তিনি বলেন, ‘এর সঙ্গে মানানসই, যথোপযুক্ত সার্কিট ব্রেকার ব্যবহার করতে হবে। এই দুটো হলো ইলেক্ট্রিক্যাল বিষয়ে থেকে সতর্কমূলক ব্যবস্থা। এর সঙ্গে আছে এসি সার্ভিসিং করা, বছরে অন্তত একবার সার্ভিসিং করাতে হবে। আমরা গরমকালে এসি ব্যবহার করা শুরু করি। তার আগে আগে একবার এসি সার্ভিসিং করে নেওয়া ভালো। গ্যাস চার্জিংটা ঠিক আছে কিনা, গ্যাস লিক হয় কিনা তা ভালো করে চেক করা প্রয়োজন ।